ফিলিস্তিন, কাশ্মির, আরাকান কিংবা অন্য কোথাও ইহুদিবাদী শক্তি আর কোথাও তাদের অনুসারী শাসকদের হাতে রক্ত ঝরছে নিরীহ সাধারণ মুসলমানের। ইমাম হোসাইন রা:-এর বিপ্লব ছিল স্বৈরশাসক, নৈরাজ্যবাদী, রাজতন্ত্রী আলেম এবং রাজাদের কেনা এলিটদের বিরুদ্ধে। রাসূলে পাক সা:-এর ওফাতের অর্ধশত বছর পার না হতেই তাঁর এই দৌহিত্রকে হত্যা করা হলো। এর আগে বনি উমাইয়ার শাসকরা ক্ষমতার রাজনীতির ময়দান দখল করে নেন। থেকেই জনগণ ক্ষমতায় গোষ্ঠী বিশেষে প্রভাবের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। বাইতুল মালের অর্থ আত্মসাৎ এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলকে বংশীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে তারা অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। এ সময় বাইতুল মালকে জনগণের এবং ‘উমাইয়াদের’ বাইতুল মাল হিসেবে ভাগ করে ফেলা হয়। জনগণের জাকাতের অর্থ ইয়াজিদের বায়াতের পক্ষে উৎকোচ-উপঢৌকন হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। আরব এবং ইরানি কিংবা ধনী এবং দাসদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়। রাসূলে পাকের পবিত্র মিম্বরসহ বহু মসজিদে খুতবায় দাঁড়িয়ে হজরত আলী রা:-এর ওপর অভিসম্পাতের অপসংস্কৃতি চালু করা হয়। যেসব মহান সাহাবি এবং তাবেয়ি এসব মেনে নেননি তাঁদেরকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়। আর এই কর্মকাণ্ডের সমর্থনে এগিয়ে আসে একশ্রেণীর ‘দরবারি আলেম’ এবং সমাজের এলিট গোষ্ঠী।
ইমাম হোসাইনের আন্দোলন ছিল যুগপৎ রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক। তিনি তাঁর কারবালার ঘটনা-পূর্ব ভাষণে বলেছেন, ‘জেনে রাখ, এ শাসকরা (বনি উমাইয়া) শয়তানের আদেশ মেনে চলছে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করছে এবং দুর্নীতিকে প্রতিদিনকার নিয়ম বানিয়েছে। তারা অধিকারগুলোকে এক জায়গায় জমা করেছে। মুসলমানদের সম্পদের ভাণ্ডারকে (বাইতুল মা’ল) নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে; আল্লাহর হারামকে অনুমতি দিয়েছে এবং তাঁর হালালকে নিষেধ করে দিয়েছে। সব মানুষের চাইতে আমিই সবচেয়ে যোগ্য তাদের বিরোধিতা করার জন্য’ (তাবারি)
মিনার ভাষণটি ইমাম হোসাইন রা: দিয়েছিলেন তাঁর মক্কায় থাকার সময়ে। আমির মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর যখন ইয়াজিদের পক্ষে বায়াত করার জন্য তাঁর ওপর জোর-জবরদস্তি শুরু হয়, তখন তিনি মদিনা ত্যাগ করে মক্কার উদ্দেশে রওনা দেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল হজ পালন করা এবং হজের জন্য আগত মুসলিম বিশ্বের মানুষের উদ্দেশে সতর্কবাণী পৌঁছে দেয়া, শাসকগোষ্ঠী মাত্রাছাড়া জাহেলিয়াত, সুন্নাহবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের সচেতন করা। সে লক্ষ্যেই ৬০ হিজরির জিলহজ মাস নাগাদ মিনায় ইমাম হোসাইন এ ভাষণ দেন।
ভাষণে তিনি কুরআনের আয়াত পাঠ করেন, ‘কেন ধার্মিক ব্যক্তিরা (আল্লাহওয়ালা আলেমরা) এবং পণ্ডিতরা তাদের পাপের কথা ও নিষিদ্ধ বস্তু ভক্ষণের ব্যাপার নিষেধ করে না? নিশ্চয় তারা যা করছে, তা অত্যন্ত জঘন্য।’ (সূরা মায়িদা : ৬৪)
তিনি বলেন, আলেমদের শ্রদ্ধার মাপকাঠি জনগণের নিকটে এজন্য হওয়া উচিত যে, তাঁরা আল্লাহর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন এবং জনগণকে সংগঠিত করেন। দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে যেখানেই নিপীড়িত মানুষ রয়েছে, যেখানেই জালেমরা মজলুমের রক্ত ঝরাচ্ছে সেখানেই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠবে আলেম এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ।
ইমাম হোসাইন বলছেন, আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে, তোমরা আল্লাহর কারণে জনগণের মধ্যে সম্মানের পাত্র। এখন তোমরা স্বচক্ষে আল্লাহর নির্দেশ-আল্লাহর প্রতি কৃত অঙ্গীকারগুলোকে ভঙ্গ হতে দেখেও কেন ভয় করছ না?’ ‘তোমাদের ব্যাপারে আমার আশঙ্কা হয় যে, ঐশী কোনো প্রতিশোধ তোমাদের ওপর নেমে আসবে।’
ইমাম হোসাইন বলছেন, ‘মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষকে ভয় করো না। ভয় করো আমাকে।’ (সূরা মায়িদা : ৪৪)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘মুমিন নর-নারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ করে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে। (সূরা তওবা : ৭১)।’ ‘আল্লাহ সৎ কাজের নির্দেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করাকে ফরজ করেছেন। কারণ, তিনি জানতেন, যদি এ ফরজটি পালন করা হয় বা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সহজ-কঠিন সব ফরজই পালন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ হলো- অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া অধিকার ফিরিয়ে দেয়া (এর জন্য সংগ্রাম করা), জালিমের বিরোধিতা, বাইতুল মাল ও গণিমত বণ্টন, জাকাতের নিসাব থেকে জাকাত গ্রহণ এবং তা যথার্থ খাতে ব্যয় করা।’
‘নির্দেশাবলি ও বিধি-বিধানের বাস্তবায়ন আল্লাহর জ্ঞানে পণ্ডিত ও বিদ্ব্যানের ওপর ন্যস্ত যারা তাঁর হালাল ও হারামের বিশ্বস্ত রক্ষক এবং শাসনকর্তৃত্ব তাদের হাতেই থাকতে হবে। সুতরাং তোমরা হলে তারাই যাদের থেকে সেই পদ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এর কারণ, তোমরা সত্যপথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছ এবং যথেষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সা:-এর নীতিপন্থা সম্পর্কে মতবিরোধ সৃষ্টি করেছ।’
তিনি আরো বলেন, ‘তারা (আলেম এবং বুদ্ধিজীবী) যারা জালিম ছিল তাদের নোংরা ও জঘন্য কাজ প্রত্যক্ষ করত, কিন্তু তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করত না- তাদের হাতে যা ছিল তার লোভে এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ার ভয়ে।’ ‘তোমাদের (আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের) এরূপ মানসিকতা (উদাসীনতা) এবং জীবনপদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমেই তোমরা অক্ষমদের তাদের অধীন করেছ। ফলে অক্ষমদের একদল এখন তাদের গোলামি শুরু করেছে। আরেকদল এক লোকমা খাবারের সন্ধানে নিরুপায় হয়ে পড়েছে। এসব শাসক তাদের মতো করে রাষ্ট্রকে ওলট-পালট এবং পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে।’
তিনি বলেছেন : ‘ তোমরা যদি (জালেমদের) নিপীড়নে ধৈর্যধারণ করো এবং আল্লাহর পথে সহনশীল হও, তাহলে শাসনকর্তৃত্ব তোমাদের হাতে ফিরে আসবে এবং তোমাদের পক্ষ থেকেই বাস্তবায়ন হবে এবং তোমরাই জনগণের বিষয়াদির সমাধানস্থলে পরিণত হবে।’ পরিশেষে ইমাম বলেন, ‘ হে আল্লাহ! তুমি জান যে, আমার থেকে যা কিছু প্রকাশ পেয়েছে তা শাসনকর্তৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নয় এবং দুনিয়ার পণ্যের লোভেও নয়। এ জন্য যে, তোমার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত দেখব এবং তোমার রাজ্যে সংস্কার করব আর তোমার নিপীড়িত বান্দাদের চিন্তামুক্ত করব এবং তোমার ওয়াজিব ও (নবীর) সুন্নাত এবং বিধি-বিধান পালন করব।’
এই ভাষণে জনগণের উদ্দেশে তাঁর শেষ কথা ছিল- ‘তোমাদের উচিত আমাদের সহায়তা করা। আমাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা। জালিমদের শক্তি তোমাদের ওপর রয়েছে। তারা তোমাদের নবীর নূরকে নিভিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। আর আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাঁর ওপরেই ভরসা করি, তাঁর দরবারেই প্রত্যাবর্তন করব। শেষ পরিণতি তাঁরই অভিমুখে।’